Sep 05, 2024

ঘুমের গুরুত্ব: সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য ও সঠিক ঘুমের নিয়মাবলী (Sleep Hygiene)

Expert Tips: Dr. Mohibulla Mollah

Sleep Hygiene Tips Dr Mohibulla Mollah

আধুনিক জীবনে ব্যস্ততা, কাজের চাপ ও প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আমরা ঘুমের সাথে সবচেয়ে বেশি আপস করি। অথচ, ঘুম কেবল বিশ্রাম নেওয়া নয়; এটি আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক 'মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ' (Repair and Maintenance) প্রক্রিয়া। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন রাতে ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে আমাদের শরীর ও মনে নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা তৈরি হয়, যার মধ্যে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং মানসিক অবসাদ অন্যতম। আজকের ব্লগে আমরা জানব "স্লিপ হাইজিন" বা ভালো ঘুমের অভ্যাস কীভাবে গড়ে তোলা যায়।

ঘুম কেন এত জরুরি? (Science of Sleep)

ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক সারাদিনের তথ্যগুলো গুছিয়ে রাখে (Memory Consolidation) এবং শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো মেরামত করে। পর্যাপ্ত ঘুমের উপকারিতা অপরিসীম:

  • মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা: ঘুম স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা বাড়ায় এবং মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: ঘুমের সময় শরীর 'সাইটোকাইনস' (Cytokines) নামক প্রোটিন তৈরি করে, যা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে।
  • মানসিক স্বাস্থ্য: পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা কমায়। অনিদ্রা মেজাজ খিটখিটে করে দেয় এবং ধৈর্য কমিয়ে দেয়।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ: কম ঘুমলে শরীরে 'ঘেরলিন' (ক্ষুধার হরমোন) বেড়ে যায় এবং 'লেপটিন' (তৃপ্তির হরমোন) কমে যায়, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে এবং ওজন বৃদ্ধি পায়।
  • হার্ট ও রক্তনালীর সুরক্ষা: ঘুমের সময় রক্তচাপ কমে, যা হার্ট ও রক্তনালীর বিশ্রামের জন্য জরুরি। দীর্ঘদিনের অনিদ্রা উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

ভালো ঘুমের ৭টি কার্যকরী টিপস (Sleep Hygiene Rules)

ঘুমের মান উন্নত করতে এবং দ্রুত ঘুমানোর জন্য নিচের অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এগুলোকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় 'স্লিপ হাইজিন' বলা হয়:

১. নির্দিষ্ট সময় মেনে চলা (Consistency)

প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর এবং সকালে ওঠার একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন। এমনকি ছুটির দিনেও এই রুটিন ভাঙবেন না। এটি শরীরের 'বায়োলজিক্যাল ক্লক' বা দেহঘড়ি (Circadian Rhythm) ঠিক রাখতে সাহায্য করে, ফলে নির্দিষ্ট সময়ে এমনিতেই ঘুম চলে আসে।

২. ডিজিটাল ডিটক্স (Digital Detox)

মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভির স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো (Blue Light) আমাদের মস্তিষ্কের 'মেলাটোনিন' হরমোন নিঃসরণে বাধা দেয়। মেলাটোনিন আমাদের ঘুমের সংকেত দেয়। তাই ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন। প্রয়োজনে বই পড়ুন বা হালকা গান শুনুন।

৩. রাতের খাবার ও ক্যাফেইন

ঘুমানোর অন্তত ২-৩ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার শেষ করুন। ঘুমানোর ঠিক আগে ভারী বা মশলাদার খাবার খেলে এসিডিটি বা বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে, যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। বিকেল ৪টার পর চা বা কফি পরিহার করুন, কারণ ক্যাফেইন শরীরে ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সক্রিয় থাকে এবং মস্তিষ্ককে উত্তেজিত রাখে।

৪. ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশ (Environment)

শোবার ঘরটি যেন ঘুমের জন্য উপযুক্ত হয়। ঘরটি অন্ধকার, শান্ত এবং আরামদায়ক তাপমাত্রায় রাখুন। আলো ঘুমের হরমোন তৈরিতে বাধা দেয়। প্রয়োজনে আই মাস্ক বা ইয়ার প্লাগ ব্যবহার করতে পারেন। বিছানা কেবল ঘুমের জন্যই ব্যবহার করুন, অফিসের কাজ বা খাওয়ার জন্য নয়।

৫. দিনের বেলার ঘুম পরিহার করুন

দুপুরে ২০ মিনিটের বেশি ঘুমানো (Power Nap) ঠিক আছে, কিন্তু দীর্ঘ সময় ঘুমালে রাতে ঘুমের চাপ কমে যায় এবং সমস্যা হতে পারে।

৬. নিয়মিত শরীরচর্চা

নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীর ক্লান্ত হয় এবং রাতে গভীর ঘুম হয়। তবে ঘুমানোর ঠিক আগে ভারী ব্যায়াম করা উচিত নয়, এতে শরীর উত্তেজিত হয়ে ঘুম আসতে দেরি হতে পারে। সকাল বা বিকেলে ব্যায়াম করা সবচেয়ে ভালো।

৭. রিলাক্সেশন টেকনিক

ঘুমানোর আগে কুসুম গরম পানিতে গোসল করা, মেডিটেশন করা বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (Deep Breathing) মস্তিষ্ক ও শরীরকে শান্ত করতে সাহায্য করে।

অনিদ্রা বা ইনসোমনিয়া (Insomnia) কী?

যদি বিছানায় যাওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যেও ঘুম না আসে, মাঝরাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায় এবং সকালে ওঠার পর শরীর সতেজ লাগে না—তবে এটি ইনসোমনিয়ার লক্ষণ। দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায় এবং জীবনযাত্রার মান নষ্ট করে।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন যদি:

  • ঘরোয়া নিয়ম মেনে চলার পরেও ১ মাসের বেশি সময় ধরে ঘুমের সমস্যা থাকে।
  • ঘুমের মধ্যে জোরে নাক ডাকা বা দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অনুভূতি হয় (স্লিপ অ্যাপনিয়া - Sleep Apnea)।
  • ঘুমের অভাবে দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ দিতে সমস্যা হয় বা মেজাজ খুব খারাপ থাকে।
  • সারাদিন অতিরিক্ত তন্দ্রাভাব থাকে বা গাড়ি চালানোর সময় ঘুম চলে আসে।
  • ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ (যেমন হাঁটা বা কথা বলা) দেখা দেয়।