Nov 15, 2024

সুস্থ হার্ট, সুস্থ জীবন: হৃদরোগ প্রতিরোধের উপায়, ডায়েট ও বিস্তারিত গাইডলাইন

Expert Advice: Dr. Mohibulla Mollah

Heart Health Guide Dr Mohibulla Mollah

মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিরামহীন পরিশ্রমী অঙ্গ হলো হৃৎপিণ্ড বা হার্ট। এটি আমাদের শরীরের ইঞ্জিন, যা পাম্প করে প্রতিটি কোষে রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। কিন্তু বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, চর্বিযুক্ত খাবার, দূষণ এবং মানসিক চাপের কারণে খুব অল্প বয়সেই মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো কার্ডিওভাসকুলার রোগ। হার্ট অ্যাটাক এখন আর শুধু বয়স্কদের রোগ নয়, তরুণরাও এর ঝুঁকিতে আছে। হার্ট ভালো রাখা কোনো কঠিন কাজ নয়, প্রয়োজন শুধু সচেতনতা এবং প্রতিদিনের অভ্যাসে ছোট কিছু পরিবর্তন।

হৃদরোগ কেন হয়? (Risk Factors)

হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ হুট করে হয় না। দীর্ঘদিনের অনিয়ম এবং বদভ্যাস এর পেছনে দায়ী থাকে। প্রধান কারণগুলো হলো:

  • উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড প্রেশার হার্টের ধমনীর ক্ষতি করে এবং হার্টকে রক্ত পাম্প করতে বাড়তি পরিশ্রম করতে বাধ্য করে।
  • উচ্চ কোলেস্টেরল: রক্তে খারাপ চর্বি বা এলডিএল (LDL) বেড়ে গেলে তা রক্তনালীর গায়ে জমে প্ল্যাক বা ব্লক তৈরি করে, যা হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ।
  • ধূমপান: ধূমপায়ীদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। নিকোটিন রক্তনালীকে সংকুচিত করে এবং রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
  • স্থূলতা ও অলসতা: শারীরিক পরিশ্রম না করা এবং অতিরিক্ত ওজন হার্টের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। পেটের চর্বি বা ভুঁড়ি হার্টের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।
  • ডায়াবেটিস: অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড সুগার সময়ের সাথে সাথে রক্তনালী ও নার্ভের ক্ষতি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারে বাবা-মায়ের বা নিকটাত্মীয়ের হৃদরোগ থাকলে সন্তানদের ঝুঁকি বেশি থাকে।

হার্ট ভালো রাখার আদর্শ খাদ্যতালিকা (Heart-Healthy Diet)

খাবার হতে হবে সুষম, আঁশযুক্ত এবং কম তেল-চর্বি যুক্ত। 'ড্যাশ ডায়েট' (DASH Diet) হার্টের জন্য সবচেয়ে উপকারী। নিচে হার্টের জন্য উপকারী ও ক্ষতিকর খাবারের বিস্তারিত তালিকা দেওয়া হলো:

খাদ্য উপাদান হার্টের বন্ধু (নির্দ্বিধায় খাবেন) হার্টের শত্রু (এড়িয়ে চলবেন)
তেল ও চর্বি অলিভ অয়েল, সরিষার তেল (পরিমিত), মাছের তেল (ওমেগা-৩), অ্যাভোকাডো, বাদাম (কাঠবাদাম, আখরোট)। ডালডা, ঘি, মাখন, পাম অয়েল, নারকেল তেল, একবার ভাজা তেল বারবার ব্যবহার করা।
প্রোটিন সামুদ্রিক মাছ (রুই, কাতলা, ইলিশ, টুনা), ছোট মাছ, ডাল, মটরশুঁটি, চামড়া ছাড়া মুরগি। গরুর মাংস, খাসির মাংস, হাঁসের মাংস, কলিজা, মগজ, প্রক্রিয়াজাত মাংস (সসেজ, বার্গার প্যাটি)।
ফল ও সবজি রঙিন শাকসবজি, টমেটো, গাজর, লাউ, ব্রোকলি, পেয়ারা, আপেল, কমলা, বেদানা। অতিরিক্ত মিষ্টি ফল (যাদের ডায়াবেটিস আছে), ক্যানড ফ্রুটস (চিনির রসে ডোবানো), ফলের রস (আঁশ ছাড়া)।
অন্যান্য ওটস, লাল আটা, লাল চাল, গ্রিন টি, ডার্ক চকলেট (৭০% কোকো), রসুন। কাঁচা লবণ, ফাস্ট ফুড, চিপস, কোল্ড ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস, বেকারি আইটেম।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণসমূহ (Warning Signs)

অনেক সময় গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা ভেবে আমরা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ অবহেলা করি। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে হার্টের পেশী স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত সতর্ক হোন:

  • বুকে প্রচণ্ড চাপ, মোচড়ানো ব্যথা বা ভারি অনুভব করা (মনে হবে কেউ পাথর চাপা দিয়েছে)।
  • ব্যথা বুক থেকে বাম হাতে, কাঁধে, ঘাড়ে, চোয়ালে বা পিঠে ছড়িয়ে পড়া।
  • প্রচুর ঘাম হওয়া (Cold Sweat) এবং শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
  • তীব্র শ্বাসকষ্ট (Shortness of Breath) হওয়া, মনে হবে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
  • বমি বমি ভাব, বদহজম বা পেটের ওপরের দিকে ব্যথা।
  • মাথা ঘোরা এবং অকারণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।

সুস্থ হার্টের জন্য ৪টি মূলমন্ত্র (Lifestyle Tips)

১. লবণ কমান (Low Sodium Intake)

অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপের প্রধান কারণ। লবণে থাকা সোডিয়াম শরীরে পানি ধরে রাখে, যা রক্তের আয়তন বাড়িয়ে দেয় এবং হার্টের ওপর চাপ ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দিনে ৫ গ্রামের (এক চা চামচ) বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। রান্নায় লবণের ব্যবহার কমান এবং পাতে কাঁচা লবণ খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করুন।

২. সক্রিয় থাকুন (Physical Activity)

হার্ট একটি পেশী, তাই একে শক্তিশালী রাখতে ব্যায়াম জরুরি। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট বা প্রতিদিন ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটলে হার্ট সুস্থ থাকে। এটি রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে সাহায্য করে। লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন এবং একটানা বসে কাজ করবেন না।

৩. ধূমপান ত্যাগ করুন (Quit Smoking)

ধূমপান হার্টের সবচেয়ে বড় শত্রু। ধূমপান ছাড়ার মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে রক্তচাপ স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং ১ বছরের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৫০% কমে যায়। পরোক্ষ ধূমপান (Passive Smoking) বা অন্যের বিড়ির ধোঁয়াও হার্টের জন্য সমান ক্ষতিকর।

৪. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট (Stress Management)

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে যা হার্টের ক্ষতি করে। স্ট্রেস কমাতে পরিবারের সাথে সময় কাটান, পর্যাপ্ত ঘুমান (৭-৮ ঘণ্টা), যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন করুন এবং শখের কাজগুলোতে ব্যস্ত থাকুন।

নিয়মিত চেকআপ (Know Your Numbers)

৩৫ বছরের পর থেকে বছরে অন্তত একবার নিচের পরীক্ষাগুলো করানো জরুরি, এমনকি কোনো সমস্যা না থাকলেও:

  • লিপিড প্রোফাইল (Lipid Profile): রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা দেখার জন্য।
  • ব্লাড প্রেশার: নিয়মিত প্রেশার মাপুন। স্বাভাবিক মাত্রা ১২০/৮০ mmHg।
  • ইসিজি (ECG) ও ইকোকার্ডিওগ্রাম: হার্টের রিদম ও পাম্পিং ক্ষমতা দেখার জন্য।
  • ব্লাড সুগার: ডায়াবেটিস আছে কিনা জানার জন্য, কারণ ডায়াবেটিস হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।