ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নিয়েছে, যা 'নীরব ঘাতক' (Silent Killer) নামেও পরিচিত। এটি এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়, কিন্তু সঠিক নিয়মে চললে একে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। ওষুধ বা ইনসুলিনের পাশাপাশি সঠিক খাদ্যভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি। আজকের এই ব্লগে আমরা জানব ডায়াবেটিস কেন হয়, এর লক্ষণগুলো কী এবং কীভাবে ঘরে বসেই একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ডায়াবেটিস কী এবং কেন হয়?
আমাদের শরীরে অগ্ন্যাশয় (Pancreas) থেকে 'ইনসুলিন' নামক এক প্রকার হরমোন নিঃসৃত হয়। এই ইনসুলিনের কাজ হলো রক্তে থাকা গ্লুকোজ বা শর্করাকে শরীরের কোষে পৌঁছে দেওয়া, যা পরবর্তীতে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। যখন শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হয় না অথবা উৎপাদিত ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। এই অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ বলা হয়।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
- টাইপ ১ ডায়াবেটিস: এটি একটি অটোইমিউন রোগ যেখানে শরীর ইনসুলিন তৈরি করতেই পারে না। এটি সাধারণত শিশু বা কম বয়সীদের হয় এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য বাইরে থেকে ইনসুলিন নিতে হয়।
- টাইপ ২ ডায়াবেটিস: এটি সবচেয়ে সাধারণ প্রকার। এখানে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করে না বা তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না (Insulin Resistance)। এটি সাধারণত বয়স্কদের, স্থূল ব্যক্তিদের এবং কায়িক পরিশ্রম না করা মানুষদের বেশি হয়।
- জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস: গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে কিছু নারীর রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, যা সন্তান প্রসবের পর সাধারণত ঠিক হয়ে যায়। তবে পরবর্তীতে তাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
লক্ষণসমূহ (Warning Signs)
ডায়াবেটিস হলে শরীর কিছু সংকেত দেয়, যা অবহেলা করা উচিত নয়:
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, বিশেষ করে রাতের বেলা (Polyuria)।
- প্রচণ্ড পিপাসা লাগা এবং গলা শুকিয়ে যাওয়া (Polydipsia)।
- প্রচুর খাওয়া সত্ত্বেও ওজন দ্রুত কমে যাওয়া এবং শরীর দুর্বল লাগা।
- অকারণে ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা।
- শরীরের কোনো ক্ষত শুকাতে অনেক সময় লাগা।
- দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসা।
- হাত-পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরা বা অবশ ভাব হওয়া (Neuropathy)।
- বারবার চামড়ায়, দাঁতের মাড়িতে বা মূত্রনালীতে সংক্রমণ হওয়া।
ডায়াবেটিস রোগীর পূর্ণাঙ্গ খাদ্যতালিকা (Diet Plan)
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাবারের ভূমিকা ৭০%। খাবার হতে হবে সুষম এবং কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) যুক্ত। নিচে একটি আদর্শ তালিকা দেওয়া হলো:
| খাদ্য উপাদান | নির্দ্বিধায় খাবেন (Green Zone) | পরিমিত খাবেন (Yellow Zone) | এড়িয়ে চলবেন (Red Zone) |
|---|---|---|---|
| শর্করা (Carbs) | লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি, ওটস, সাগুদানা, ভুট্টা। (এগুলোতে ফাইবার বেশি থাকে)। | সাদা ভাত, সাদা আটার রুটি, মুড়ি, চিড়া, বিস্কুট (সুগার ফ্রি)। | চিনি, গুড়, মধু, কেক, পেস্ট্রি, আইসক্রিম, সাধারণ বিস্কুট। |
| সবজি | লাউ, করলা, পটল, শসা, ব্রোকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, সব ধরনের শাক, টমেটো। | গাজর, বিট, মটরশুঁটি, শালগম, কাঁচা পেঁপে। | আলু, কচু, মিষ্টি কুমড়া, কাঁচকলা, ওল। (এগুলোতে স্টার্চ বেশি থাকে)। |
| ফল | জামরুল, পেয়ারা, আমলকী, বাতাবি লেবু, কদবেল, টক বড়ই, জাম। | আপেল, কমলা, পেঁপে, তরমুজ, বেদানা, নাসপাতি। | আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, সবেদা, আঙ্গুর, খেজুর, কিসমিস। |
| প্রোটিন | ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, মুরগির মাংস (চামড়া ছাড়া), ডিমের সাদা অংশ, টক দই। | ডাল, বাদাম, পনির, সয়াবিন। | গরুর মাংস, খাসির মাংস, প্রসেসড মিট (সসেজ), চিংড়ি মাছ। |
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন (Lifestyle Modification)
শুধুমাত্র ওষুধে কাজ হবে না, দৈনন্দিন অভ্যাসে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে:
- নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট ঘাম ঝরিয়ে দ্রুত হাঁটুন। হাঁটার ফলে পেশীগুলো গ্লুকোজ ব্যবহার করে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে এবং ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ে। লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি (বিশেষ করে পেটের চর্বি) ইনসুলিনকে কাজ করতে বাধা দেয়। শরীরের ওজন উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় (BMI) রাখুন।
- পায়ের যত্ন (Foot Care): ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের অনুভূতি কমে যায় এবং রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়। তাই প্রতিদিন পা পরীক্ষা করুন, নরম ও আরামদায়ক জুতো পরুন এবং খালি পায়ে হাঁটা সম্পূর্ণ বন্ধ করুন। নখ কাটার সময় সতর্ক থাকুন যাতে ক্ষত না হয়।
- মানসিক চাপ কমানো: অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস হরমোন (করটিসোল) রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত মেডিটেশন, নামাজ বা প্রার্থনা এবং পর্যাপ্ত ঘুম (৭-৮ ঘণ্টা) মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে।
- ধূমপান বর্জন: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ধূমপান বিষতুল্য। এটি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে সুগার কমে যাওয়া) - জরুরি সতর্কতা
অনেক সময় ওষুধের প্রভাবে বা দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে রক্তে শর্করার মাত্রা খুব কমে যেতে পারে (৩.৯ mmol/L এর নিচে)। একে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে। এটি সুগার বেড়ে যাওয়ার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক এবং দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
লক্ষণসমূহ:
- হাত-পা কাঁপা ও বুক ধড়ফড় করা।
- প্রচুর ঘাম হওয়া ও শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
- প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগা।
- মাথা ঘোরা, চোখে ঝাপসা দেখা এবং অসংলগ্ন আচরণ করা।
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (কোমা)।
তাৎক্ষণিক করণীয় (Rule of 15):
দ্রুত ১৫ গ্রাম গ্লুকোজ বা চিনি বা মিষ্টি কোনো পানীয় (যেমন শরবত) রোগীকে খাওয়ান। ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। যদি সুগার স্বাভাবিক না হয়, তবে আবার খাওয়ান। রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে কিছু দেবেন না, দ্রুত হাসপাতালে নিন।
নিয়মিত চেকআপ ও মনিটরিং
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা তা বোঝার জন্য নিয়মিত সুগার চেক করা জরুরি।
- খালি পেটে (Fasting): সকালে নাস্তার আগে। লক্ষ্যমাত্রা: ৪.৪ - ৬.১ mmol/L
- খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর (2hABF): লক্ষ্যমাত্রা: ৭.৮ mmol/L এর নিচে।
- HbA1c: এটি গত ৩ মাসের গড় শর্করার পরিমাণ নির্দেশ করে। এটি ৭% এর নিচে রাখা ভালো। বছরে অন্তত ২ বার এই পরীক্ষা করা উচিত।
- অন্যান্য পরীক্ষা: বছরে অন্তত একবার চোখ (Retina), কিডনি (Creatinine) এবং পায়ের নার্ভের পরীক্ষা করানো উচিত।